আজকের দিন তারিখ ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সারাদেশ ৬৬ বছরে পাঁচ হাজার কবর খুঁড়েছেন বৃদ্ধ আলী হোসেন

৬৬ বছরে পাঁচ হাজার কবর খুঁড়েছেন বৃদ্ধ আলী হোসেন


পোস্ট করেছেন: delwer master | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ২৩, ২০২৩ , ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সারাদেশ


জেলা প্রতিনিধি লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরের আলী হোসেনের জন্ম ১৯৪২ সালে। কিশোর বয়স থেকে শুরু করে ৬৬ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কবর খুঁড়েছেন তিনি। তবে বছর দুয়েক আগে ব্রেইন স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই কাজে ইস্তফা দিয়েছেন। এর মধ্যে নিজের সন্তানের কবরও তিনি খুঁড়েছেন। জীবনে প্রথম কবর খোঁড়ার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আলী হোসেন বলেন, ১৯৫৫ সালের এক রাতে পাশের বাড়ির হাশমত উল্যার বাবা হাবিব উল্যা মারা যায়। তখন হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে কেউই কবর খোঁড়ার জন্য রাজি হচ্ছিল না। তখন সাহস করে বলি, আমি কবর খুঁড়বো। আমার এক ভাতিজা নুর হোসেনকে নিয়ে কবর খুঁড়তে চলে যাই। সে আমাকে শাবল, কোদাল এগিয়ে দেয়। আমি কবর খুঁড়তে থাকি আর সে ওপর থেকে বাতি ধরে থেকে আমাকে নির্দেশনা দেয়। রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে কবর খোঁড়া শেষ হয়। সেই থেকে জীবনের ৬৬ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কবর খুঁড়েছি। আলী হোসেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম বটতলী গ্রামের মৃত ছেরাজল হকের ছেলে। তিনি পেশায় গাছ কাটার মিস্ত্রি ছিলেন। তাই হোসেন মিস্ত্রি নামেই তিনি এলাকায় পরিচিত। আলী হোসেন ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির সংসারে ১০ সন্তানের জন্ম হয়। এরমধ্যে দুই ছেলে মারা যান। একজনের মরদেহ সৌদি আরবের জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়েছে। আর সংসারের ৪ নম্বর সন্তান ছোটবেলায় মারা যায়। আলী হোসেন নিজেই কবর খুঁড়ে ওই সন্তানের মরদেহ দাফন করেছেন৷

আলী হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তিনি। ইংরেজি ১৯৫৫ সালের এক রাতে প্রতিবেশী হাবিব উল্যার মরদেহ দাফনের জন্য কবর খুঁড়তে যান। সেই থেকে জীবনের ৬৬ বছর তিনি এ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। গাছ কাটার ফলে সারাদিনের ক্লান্তিও তাকে এ কাজ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। তবে অসুস্থতার কারণে গত দুই বছর আগে কবর খোঁড়ার কাজে ইস্তফা দিয়েছেন। কবর খোঁড়ার জন্য তিনি বাড়ি থেকে রামগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর, পাশের বশিকপুর, উত্তর জয়পুর, রাজাপুর ও লক্ষ্মীপুর পৌর শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছুটে গিয়েছেন। তবে এ ৬৬ বছরের কবর খোঁড়ার পুরো সময়ে তিনি একদিন ভয় পেয়েছিলেন। যেখানে একটি কবর খুঁড়তে গিয়ে তিনজনের দেহাবশেষ পেয়েছেন। এরমধ্যে একটিতে কাঁচা বাঁশ ছিল৷ এ নিয়ে তিনি সাময়িকভাবে ভীত হয়ে পড়েন। এদিকে, প্রায় ১০-১২ বছর আগে এ কাজে তিনি দুইজন সহযোগী রাখেন। তার দুই সহযোগী ছিলেন মহিন উদ্দিন ও সিরাজ উদ্দিন। এরমধ্যে মহিন উদ্দিন তার ছেলে। মূলত তাদের সহযোগী হিসেবে রাখা হয় কাজ শেখানোর উদ্দেশ্যে।

আলী হোসেন বলেন, এখন আর কবর খোঁড়ার শক্তি-সামর্থ নেই। গত দুই বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক করে অসুস্থতার কারণে এই কাজ থেকে অবসর নিয়েছি। ৬৬ বছর কবর খুঁড়েছি। এক মাসে সর্বোচ্চ ২০টি কবর খুঁড়েছি। আনুমানিক পাঁচ হাজার কবর খুঁড়েছি। তবে কখনো কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নিইনি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সম্পূর্ণ বিনাপারিশ্রমিকে এ কাজ করেছি। তবে আমার দুই সহযোগীকে মৃতের স্বজনরা কিছু টাকা দিতেন। আলী হোসেনের বড় ছেলে মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, পরিবার থেকে আমরা বাবাকে সবসময় উৎসাহ দিয়ে এসেছি। গভীর রাতেও তিনি কবর খোঁড়ার জন্য বের হয়ে যেতেন৷ ঝুঁকি থাকলেও কলেরা মহামারিতে মৃতদের জন্যও তিনি কবর খুঁড়েছেন। এরপরও কখনো তাকে এ কাজে বাধা দিইনি। এখন বয়স বেড়েছে। এজন্য এ কাজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

কবর খোঁড়ায় আলী হোসেনের সহযোগী মহিন উদ্দিন বলেন, আমি বাবার কাছ থেকে কবর খোঁড়া শিখেছি। চারপাশে কতটুকু জায়গা নিতে হবে, কতটুকু গভীর করতে হবে সব বাবা আমাকে শিখিয়েছেন। স্বেচ্ছায় বাবার সঙ্গে গিয়ে কাজটি শিখেছি। আমি ১০-১২ বছর ধরে কবর খুঁড়ছি। দত্তপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মামুনুর রশিদ বলেন, আলী হোসেন আমার প্রতিবেশী। তিনি সবার কাছে হোসেন মিস্ত্রি হিসেবে পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আশপাশের সব কবর তিনি খুঁড়েছেন। কয়েক মাস আগে আমার বাবা মারা যান। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি আমার বাবার কবরটি খুঁড়তে পারেননি। তবে যারা খুঁড়েছেন কবরস্থানে এসে তাদের সহযোগিতা করেছেন। এ কাজে তিনি কখনো এক পয়সাও কারও কাছ থেকে নেননি।