আজকের দিন তারিখ ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
ধর্ম ও জীবন জুমার প্রথম খুতবা : হাজিদের প্রতি কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশ ও ফজিলত

জুমার প্রথম খুতবা : হাজিদের প্রতি কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশ ও ফজিলত


পোস্ট করেছেন: delwer master | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ১৬, ২০২৩ , ৩:৩২ অপরাহ্ণ | বিভাগ: ধর্ম ও জীবন


ইসলাম ডেস্ক : বরকতময় হজের প্রস্তুতির মাস জিলকদের চতুর্থ জুমা আজ। ১৬ জুন ২০২৩ ইংরেজি, ০২ আষাঢ় ১৪৩০ বাংলা, ২৬ জিলকদ ১৪৪৪ হিজরি। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- হাজিদের প্রতি কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশ ও ফজিলত।

প্রিয় মুসল্লিগণ!
হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন যে ব্যক্তির মালিকানায় নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র এবং নিজের ও পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচের অতিরিক্ত এমন পরিমাণ টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা বা জমিজমা রয়েছে, যা দ্বারা সে হজে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজকালীন সময়ে সাংসারিক খরচ মেটাতে সক্ষম। তার ওপর হজ আদায় করা ফরজ। আর এ হজ জীবনে একবারই ফরজ। ফরজ হজ আদায়ের পর বার বার হজ করলে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে।

সামথ্যবান মানুষের ওপর হজ করা ফরজ। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা বিষয়টি এভাবে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন-
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ
‘আর সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বাইতুল্লাহর হজ করা ফরজ।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ৯৭)
প্রিয় মুসল্লিগণ!
এ আয়াতে কারিমায় মহান আল্লাহ তাআলা সামর্থ্যবান মানুষকে তাঁর ইবাদত হজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে। সম্পূর্ণ রাহা-খরচ পূরণ হওয়ার মত যথেষ্ট পাথেয় যার কাছে আছে। অনুরূপ রাস্তার ও জান-মালের নিরাপত্তা এবং শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদিও সামর্থ্যের অন্তর্ভুক্ত। নারীর জন্য মাহরাম (স্বামী অথবা যার সঙ্গে তার বিবাহ চিরতরে হারাম এমন কোন লোক) থাকাও জরুরি। (ফাতহুল কাদির) এই আয়াত প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ ফরজ হওয়ার দলিল। হাদিস দ্বারা এ কথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হজ জীবনে একবারই ফরজ। (ইবনে কাসির)

হজ আদায়কারীর প্রতি কোরআন মাজিদের হেদায়াত
হজ সম্পর্কে কোরআন মাজিদে সুরা বাকারার ১৯৬-২০৩ পর্যন্ত মোট ৮টি আয়াতে জরুরি হেদায়াত দেওয়া হয়েছে। হজ আদায়কারীর জন্য সেগুলোর প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। তাই এ আয়াতগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা পড়ে নেওয়া উচিত। নিম্নে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ দু’একটি আয়াত উল্লেখ করা হলো-
وَ اَتِمُّوا الْحَجَّ وَ الْعُمْرَةَ لِلّٰهِ ؕ
‘আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরা পূর্ণ করো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৯৬)
এই আয়াতে হজ ও ওমরার নিয়ত ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়েছে। তাহলো, একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। সুতরাং দুনিয়ার যশ-খ্যাতি, লোক-দেখানো, হাজি বা আলহাজ উপাধি পাওয়া প্রভৃতি নিয়ত থেকে বিরত থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেছেন-
اَلْحَجُّ اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمٰتٌ فَمَنْ فَرَضَ فِیْهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوْقَ وَلَا جِدَالَ فِی الْحَجِّ ؕ وَ مَا تَفْعَلُوْا مِنْ خَیْرٍ یَّعْلَمْهُ اللّٰهُ
‘হজ সুবিদিত মাসসমূহে হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের উপর হজ অবধারিত করে নেয় সে হজের সময় কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গুনাহ করবে না এবং কোনো ঝগড়াও করবে না। তোমরা যা কিছু সৎকর্ম কর আল্লাহ তা জানেন। (সুরা বাকারা: আয়াত ১৯৭)
এই আয়াতে ইহরামকারীকে মোট তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তাহলো-
১. অশ্লীল কথা বলবে না। স্ত্রীর সাথেও কামোত্তেজক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকবে।
২. সকল প্রকার গুনাহ থেকে বিরত থাকবে। অর্থাৎ ইহরামের কারণে বিশেষভাবে যা নিষিদ্ধ এবং সাধারণ অবস্থায় যা গুনাহ উভয় প্রকার নিষিদ্ধ কাজ থেকেই বিরত থাকতে হবে।
প্রকাশ থাকে যে, সাধারণ অবস্থায় যা করা গুনাহ ও নিষিদ্ধ ইহরাম অবস্থায় তা আরও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ; যেমন, অন্যকে কষ্ট দেওয়া, কু-দৃষ্টি ও গিবত-শেকায়েত ইত্যাদি।
৩. ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকবে। এটিও সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ। এ হিসেবে এটি দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। তথাপি আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে তা উল্লেখ করেছেন, যেন ঝগড়া-বিবাদ থেকে মুক্ত হয়ে হজের মতো মহান ইবাদত নির্বিঘ্নে আদায় করা যায়।

প্রিয় মুসল্লিগণ!
হজ বহু ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। হাদিসে হজের বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হল-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَنْ حَجَّ لِلّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمٍ وَلَدَتْهُ اُمُّهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে এভাবে হজ করবে যে, অশ্লীল কথাবার্তা বলবে না এবং গুনাহের কাজ করবে না সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ থেকে ফিরে আসবে যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’ (বুখারি ১৫২১, মুসলিম ১৩৫০)

হজরত আতা ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَنْ حَجَّ الْبَيْتَ فَقَضَي مَنَاسِكَهُ وَسَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ غُفِرَ لَهَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহর হজ করবে, হজের কাজগুলো যথাযথভাবে আদায় করবে এবং মুসলমানরা তার মুখ ও হাত থেকে নিরাপদ থাকবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৮৮১৭)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
اَلْعُمْرَةُ اِلَي الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا، وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ اِلاَّ الْجَنَّةُ.
‘এক ওমরার পর আরেক ওমরা করলে মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়। আর হজে মাবরুর (মাকবুল হজ)-এর প্রতিদান একমাত্র জান্নাত।’ (বুখারি ১৭৭৩, মুসলিম ১৩৪৯)

হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
اَلْحُجَّاجُ وَالْعُمَّارُ وَفْدُ اللهِ، دَعَاهُمْ فَاَجَابُوْهُ وَسَئَلُوْهُ فَاَعْطَاهُمْ.
‘হজ ও ওমরাকারীগণ আল্লাহ তাআলার দল। তিনি তাদেরকে ডেকেছেন, তারা সাড়া দিয়েছে। তারা আল্লাহ তাআলার কাছে চায় তিনি তা কবুল করেন।(মুসনাদে বাযযার ১১৫৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫২৮৮)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন অন্য বর্ণনায় এসেছে-
اَللّهُمَّ اغْفِرْ لِلْحَاجِّ وَلِمَنْ اِسْتَغْفَرَ لَهُ الْحَاجُّ
‘হে আল্লাহ! আপনি হজ আদায়কারীকে ক্ষমা করে দিন এবং সে যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তাকেও ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে খুযাইমা ২৫১৬, মুসতাদরাকে হাকেম ১৬৫৪)

হজের ক্ষেত্রে জরুরি কথা হলো-
হজের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্র এমন আছে, যেখানে অনেকে ধৈর্যধারণ করতে পারেন না। অথচ এই সফরের পুরো সময় আল্লাহ তাআলার এই হুকুম রয়েছে। তাই খুব সজাগ থাকতে হবে। কেউ বড় অন্যায় করে ফেললেও তার সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, মানুষকে ক্ষমা করে দিলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়া যাবে। বড় সফলতা অর্জিত হবে। হজের সফরে সাধারণত ঝগড়া-বিবাদ হতে দেখা যায় এমন কিছু ক্ষেত্র হলো-
> গ্রুপ লিডারের আচরণে কষ্ট পেলে কিংবা তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতির উল্টা-পাল্টা হলে। এক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করতে হবে।
> খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। এক্ষেত্রেও ধৈর্যধারণ করতে হবে।
> হোটেল নির্বাচন ও থাকার জায়গা নিয়ে। এক্ষেত্রেও ধৈর্যধারণ করতে হবে।
> মিনা ও আরাফায় নামাজ পড়া নিয়ে। এখানে ধৈর্যের সঙ্গে নামাজ পড়তে হবে।
> বিশেষ করে মিনায় থাকার জায়গা নিয়ে তো অনেকের একচোট ঝগড়া হয়েই যায়। এ থেকে সাবধান থাকতে হবে।
> মসজিদে হারামে জায়গা ধরে রাখা নিয়ে। এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। বরং যে আসবে তাকে বসার জায়গা করে দিতে হবে।
> বাসের সিট নিয়েও ঝগড়া হয়। তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অতএব নিজের হজ কবুল হওয়ার স্বার্থেই এসব বিষয়ে ঝগড়া থেকে বিরত থাকা জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব হজ পালনকারীকে হজের সফরে এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।