আজকের দিন তারিখ ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
স্পোর্টস গোলরক্ষক বাবার স্বপ্ন পূরণ করছেন উইকেটরক্ষক ছেলে

গোলরক্ষক বাবার স্বপ্ন পূরণ করছেন উইকেটরক্ষক ছেলে


পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ২৯, ২০২০ , ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: স্পোর্টস


দিনের শেষে ডেস্ক : এখনও ফুটবলে চোখ আটকে থাকে তার। কাউকে খেলতে দেখলে পা নিশপিশ করে। সুযোগ পেলে মাঠেও নেমে পড়েন। ক্ষণিকের জন্য যেন ভুলে যান তিনি একজন ক্রিকেটার। কে এই ক্রিকেটার, যিনি ফুটবলের প্রেমে আজও মশগুল? যাকে মাঠে নামিয়ে আনে ফুটবলের সেই অদৃশ্য টান? তিনি কাজী নুরুল হাসান সোহান। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। লাল-সবুজ জার্সিতে ইতোমধ্যে যার খেলা হয়ে গেছে ৩ টেস্ট, ২ ওয়ানডে ও ৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। প্রথম শ্রেণির ম্যাচের সংখ্যাও একশ ছুঁইছুঁই। পেশাদার ক্রিকেটার সোহান; কিন্তু তার শরীরে যে বহমান একজন ফুটবলারের রক্ত! সেই টান থেকে দূরে সরে থাকেন কিভাবে? কী করে ভুলতে পারেন ফুটবলের মোহ? তার তো ফুটবলারই হওয়ার কথা ছিল। বাবা কাজী নাসিবুল হাসান সানু যে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন ঢাকার বেশ কয়েকটি বড় ক্লাবে। সত্তর-আশির দশকে গোলরক্ষক হিসেবে সুনামের সঙ্গে খেলেছেন ঢাকার পাশপাশি নিজ জেলা খুলনার বিভিন্ন ক্লাবেও। শুধু বাবাই নন, সোহানের এক মামাও ছিলেন ফুটবলার। খেলেছেন ঢাকার কয়েকটি ক্লাবে। ‘আমি যখন ফুটবল ছেড়ে ১৯৯২ সালে খুলনার একটি ক্লাবের কোচ কাম ম্যানেজারের দায়িত্ব নেই, তখন সোহানের বয়স দেড়-দুই বছর। একটু বড় হওয়ার পর ওর ফুটবলের প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকে। আমার সঙ্গে টাউনহল মাঠে যেত। তখন দেখতাম যে পাশে ফুটবল খেলা হয় সেদিকেই চলে যেত সোহান। আমি আর ওর মামা জিজ্ঞেস করতাম, তুমি কী হতে চাও? সোহান বলত, আমি খেলোয়াড় হবো। কিছুদিন ফুটবলের ক্যাম্পও করেছিল। পরে চারদিকে ক্রিকেটের চর্চা বেড়ে যায়। সোহানও সেদিকে ঝুঁকে পড়ে’- খুলনার মহেশ্বরপাশার বাসা থেকে ছেলের ক্রিকেটার হওয়ার গল্পটা বলছিলেন ফুটবলের সাবেক গোলরক্ষক কাজী নাসিবুল হাসান সানু। ছোট্ট সময়েরই সেই ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নিলেও, এখনও ওই চামড়ার গোলকটি টানে জাতীয় দলের অন্যতম সদস্য কাজী নুরুল হাসান সোহানকে। ‘আমি তখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। তখন খুলনায় অনূর্ধ্ব-১১ বা ১২-র একটি ফুটবল ক্যাম্প হয়েছিল। এক মাস আমি সেই ক্যাম্পে অনুশীলন করি। আমার আসলে খেলার প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল। ফুটবলে বেশি টান থাকলেও ক্রিকেটও দেখতাম, খেলতাম। সকালে ক্রিকেট আর বিকেলে ফুটবল। এভাবেই দুটি খেলা নিয়ে থাকতাম। পরে আস্তে আস্তে ক্রিকেটের দিকে চলে আসি’- খুলনা থেকে কৈশোরের খেলাধুলার দিনগুলোর কথা বলছিলেন সোহান। কবে থেকে ফুটবল একদম ছেড়ে দিলেন? সোহান বললেন, ‘ফুটবল তো আমি ছাড়িনি। এখনও খেলি সুযোগ পেলে। ফুটবলের প্রতি আমার অন্যরকম এক ভালোবাসা। আমি তিন বছর ধরে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের অধিনায়ক। ওই মাঠে যখন ফুটবলের অনুশীলন হয় তখন আমি পাশে বসে দেখি। সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে খেলতেও নেমে যাই। ক্রিকেটে পেশাদার আমি; কিন্তু হৃদয়ে এখনও ফুটবল লেগে আছে।’ কাজী নুরুল হাসান সোহানরা দুই ভাই বোন। ছোট বোন খুলনা মেডিকেল কলেজে পড়েন। সোহানের স্ত্রী তাসমিন ইসলাম। বিয়ে করেছেন চার বছর আগে। তাদের একমাত্র কন্যা কাজী সাফোয়া হাসানের বয়স ৮ মাস। সোহানের বাবা নাসিবুল হাসান সানু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ফুটবল শুরু করেছিলেন ১৯৭৬ সালে, খুলনা লিগের দল ইয়ং বয়েজ ক্লাবের হয়ে। এরপর ইয়ং মুসলিম ও খুলনা আবাহনীতে খেলেছেন। সোহরাওয়ার্দী কাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে তিনি নজরে পড়েছিলেন ঢাকার ক্লাব কর্মকর্তাদের। ১৯৭৯ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে প্রথম নাম লেখান ঢাকার প্রথম বিভাগ লিগে। এরপর ব্রাদার্স ইউনিয়ন, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে খেলেছেন। তবে ঢাকার ফুটবলে বেশি সময় খেলেছেন আরামবাগ ক্রীড়া সংঘে। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের জার্সিতেই তিনি শেষবারের মতো খেলেছেন ঢাকার ফুটবলে। পরে খুলনা গিয়ে স্থানীয় লিগে খেলেন আরও কয়েক বছর। ১৯৯৯ সালে পাড়ার ক্লাব মহেস্বরপাশার হয়ে খেলে বুট জোড়া তুলে রাখেন সানু। ক্যারিয়ারের সেই সোনালী দিনের কথা বলতে গিয়ে সাবেক এ গোলরক্ষক অনেক স্মরণীয় ঘটনাই তুলে আনেন, ‘কাজী জসিম উদ্দিন জোসী, আবদুস সালাম মুর্শেদী, রুমীদের সঙ্গে খেলেছি। বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধেও আমার খেলা হয়েছে। সেটা ছিল ১৯৮৪ সালে আবাহনীর বিরুদ্ধে আরামবাগের ম্যাচে। সম্ভবত ম্যাচটি আমরা জিতেছিলাম। পরের বছর আমরা মোহামেডানকে হারিয়েছিলাম। সেই দিনগুলোর কথা আজও মনে আছে।’ আপনি ফুটবলার ছিলেন। খেলেছেন ঘরোয়া আসরের শীর্ষ পর্যায়ে। আপনি কখনও চাননি ছেলে ফুটবলার হোক? সানুর উত্তর, ‘আমি চেয়েছিলাম। সোহানও ফুটবল খুব পছন্দ করত। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে তো ফুটবল তার জৌলুস হারাতে থাকে। চারদিকে বাড়ে ক্রিকেটের জোয়ার। ছেলে আস্তে আস্তে সে দিকেই ঝুঁকে পড়ে।’ ‘আমি ২-৩ বার জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলাম। কিন্তু লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হয়নি। আমার দেশের হয়ে খেলার স্বপ্নপূরণ হয়নি। ফুটবল ক্যারিয়ারে এই একটা দুঃখ ছিল আমার। কিন্তু আমার ছেলে ক্রিকেটে জাতীয় দলে খেলছে। আমি যে স্বপ্নপূরণ করতে পারিনি, সেটা আমার ছেলে পূরণ করেছে। এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করি যাতে সোহান আরও বড় ক্রিকেটার হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে’- বলছিলেন ৬০ বছরের সাবেক গোলরক্ষক কাজী নাসিবুল হাসান সানু। ফুটবলের সঙ্গে অনেকদিন ধরে আছেন। কোন ঘটনা আছে কি যা এখনও মনে করেন? অনেক ঘটনার মধ্যে থেকে আশির দশকের এ গোলরক্ষক দুটি স্মরণীয় দিনের কথা বললেন সানু, ‘এক. ১৯৮৫ সাল। খুলনা স্টেডিয়ামে শেরে বাংলা কাপ ফুটবলের ম্যাচ খুলনা ও বাগেরহাটের মধ্যে। আমরা মাঠে ঢুকতে গিয়ে দেখি চারদিকে দর্শক আর দর্শক। অন্তত ২০-২৫ হাজার মানুষ হবে। তাদের সরিয়ে আমরা মাঠে ঢুকব। আমি ছিলাম পেছনে। সবাই ঢুকলেও আমি বাইরে আটকা পড়ে যাই। আর ঢুকতে পারছিলাম না। তখন কয়েকজন দর্শক আমাকে কাঁধে তুলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেন।’ ‘দুই. একবার পূর্ব জার্মানির অল ইউনিভার্সিটি দল বাংলাদেশে চ্যারিটি ম্যাচ খেলতে এসেছিল। ওরা প্রথমে ঢাকায় খেলেছিল। মোহামেডান বা আবাহনীর বিরুদ্ধে হবে। সেখানে ৫ কিংবা ৬ গোলে জিতেছিল। এরপর দলটি খেলতে এসেছিল খুলনায়। সবাই বলছিল ওরা আজ ১২ গোল দিয়ে যাবে। কোচ আমাদের বললেন কী করা যায়? বেশি গোল হলে তো সর্বনাশ। ওদের আক্রমণভাগে বিপদজনক এক ফুটবলার ছিলেন। লম্বায় ৭ ফুটের কম হবে না। তার মাথা থেকে বল নেয়াই ছিল দুস্কর। আমরা প্রথমে দুই গোল খেয়ে যাই। পরে ২-২ গোলে ড্র করি। ওই ম্যাচে আমার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় গিয়েছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। আমি একটি বল ঠেকিয়েছিলাম সেটা কখনও ভুলবো না। প্রথম পোস্ট দিয়ে শট নিয়েছিল, আমি সেভ করি। আবার দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে শট নেয়। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাতে সেই বল সেভ করেছিলাম। ওটাকে ক্যারিয়ারের সেরা সেভই বলবো আমি।’