আজকের দিন তারিখ ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার, ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
জাতীয় যে জীবন অবিনশ্বর

যে জীবন অবিনশ্বর


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১:০৯ অপরাহ্ণ | বিভাগ: জাতীয়


শ্যামল দত্ত :  আমাদের যে জীবন নশ্বর, তার আয়ু কত দিনের হয়? ৫০, ৭০, ৮০, বড়জোর ১০০। কিন্তু যে জীবন মহামানবের, তার জীবনের বিস্তৃতি অনন্তকাল পর্যন্ত। মৃত্যুকে এক অলঙ্ঘনীয় দেয়াল বলে উল্লেখ করেছিলেন কোনো কোনো লেখক। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, কিছু কিছু জীবন, মৃত্যুর দেয়াল অতিক্রম করে প্রবহমান সময় থেকে সময়ে। এক মহাকাল থেকে অন্য মহাকালে- এমন জীবনইতো মহাকাব্যিক জীবন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বল্পকালীন জীবন, তার এমন এক আবহমান বিস্তৃতি, যা মৃত্যুকে অতিক্রম করে চলে গেছে অনাদিকাল পর্যন্ত। যতদিন বাঙালি থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, বাংলার সংস্কৃতি থাকবে, ততদিনই অবিরাম বয়ে যাওয়া এক জীবনের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার আকাশ-বাতাস, গাছপালা, বয়ে চলা নদী, সবুজ ধানক্ষেত, পাখির কুজন- সর্বত্র বিরাজমান একটি নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কৃষকের লাঙলের ফলায় ঠিকরে উঠে চকচকে আলো, শ্রমিকের নোনা ঘাম, স্বাবলম্বী নারীর মুখে ফুটে ওঠা হাসি, বিদ্বান ব্যক্তির কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ কিংবা মেধাবী যুবক-যুবতীর দৃঢ়পায়ে পথ চলা- কোথায় নেই তিনি। সর্বত্রই তিনি বিরাজমান, তিনি আর কেউ নন- আমাদের আজন্ম সঙ্গী- বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জন্মদাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসের একটি নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এই বাংলাদেশে একটি নক্ষত্রখচিত রাজনৈতিক পরিবারকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডে মেতেছিল হত্যাকারীরা। ষড়যন্ত্রকারীরা ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাংলাকে, বাঙালিকে, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আজ এতদিন পরও, বাংলার যেদিকে তাকাই সেদিকেই বঙ্গবন্ধু। যে ষড়যন্ত্র বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করার, যে ষড়যন্ত্র বাঙালির হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার, সেই ষড়যন্ত্রের বাস্তবতা কোথায়? বাংলাদেশ ও বাঙালির হৃদয়ে যে গভীরে প্রোথিত বঙ্গবন্ধুর নাম, সেখান থেকে কি বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে? তাহলে কেন রক্তস্নাত হলো ৩২ নম্বরের সিঁড়ি, কেন মরতে হলো এক অবুঝ শিশু শেখ রাসেলকে, এক সন্তানসম্ভবা মাকে, এক অমায়িক জীবনের স্বপ্ন আঁকা যুবককে, কেন হারাতে হলো বঙ্গমাতাকে। কেন মুছে গেল কপালের লাল টিপ, বুলেটে বিদীর্ণ হলো ভাইয়ের স্নেহ, বোনের মমতা। কেন স্তব্ধ করে দেয়া হলো মানুষের ভালোবাসায় স্নাত কোলাহলময় একটি বাড়িকে? কেন বাঙালি হারাল তার পিতাকে? পিতৃ-মাতৃহীন এক এতিম জাতিকে কেন ফেলা হলো জীবনের গভীর সংকটে এবং সেটা জন্মের মাত্র চার বছর পর? সাপের ফণার উদ্যত ছোবলে কেন বিষাক্ত হলো বাংলাদেশ? অথচ ৩০ লাখ শহীদের লাল রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এক সবুজ মানচিত্র।

বাঙালি জাতিগোষ্ঠী যাত্রা শুরু করেছিল তাদের নিজস্ব এক খণ্ড ভূমি নিয়ে। তাহলে মাত্র চার বছরের মাথায় কেন এই হত্যাকাণ্ড? এ এক অপার রহস্য, যা এখনো অনুদ্ঘাটিত। কয়েকজন হত্যাকারীর বিচার সংঘটিত হয়েছে, যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে এরকম একটি নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের হত্যাকারী। যদিও আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ করা ছিল কয়েক দশক। কিন্তু পথ রুদ্ধকারীদের তো বিচারের আওতায় আনলাম না। এমনকি আমরা বিচারের প্রক্রিয়ায় তো জানতেই পারলাম না ষড়যন্ত্রকারীরা কোথায়? পরিকল্পনাকারী কোথায়? নেপথ্যের ইন্ধনদাতা কে? দেশি-বিদেশি জড়িত চক্র কারা? কেন জানবে না জাতি- এসব বিষয়ে বৃহৎ প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে নানা প্রশ্ন জাতির সামনে।

বঙ্গবন্ধুর মতো আকাশসমান উঁচু এক ব্যক্তিত্বের বুক যদি বুলেটে ঝাঁজরা করে দেয়া যায়, তাহলে সেই ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের জাল কতখানি বিস্তৃত, সেটা সহজেই অনুমেয়। তাদের পরিকল্পনার শিখর কত গভীরে প্রোথিত, তা বোঝা একেবারেই কঠিন নয়। যেহেতু আমরা তাদের সমূলে উৎপাটন করিনি, তাই গত কয়েক দশক ধরে বাংলার আনাচে-কানাচে ঘাপটি মেরে আছে তারা। সুযোগ পেলেই আবার ছোবল মারবে ১৯৭৫ সালের মতো, এই বাংলার সবুজ প্রান্তরের উপরে। ছোবল মারার চেষ্টা তো কম হয়নি গত ৫০ বছরে। কারণ সমাজ থেকে তাদের সমূলে উৎপাটন করার কাজটা তো আমরা করিনি। বরং বংশ বিস্তার হয়েছে নানা চেহারায়। বেড়ে উঠেছে আড়ালে- আরো শক্তিশালী হয়ে। তাই তারা অপেক্ষায় আছে সময় ও সুযোগের। বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর নানাভাবে বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতিকে পাল্টে দেয়ার চেষ্টাও তো কম হয়নি। সেই চেষ্টা কি এখনো অব্যাহত নেই। তাই দেশ অগ্রসর হলে কিছু মানুষের গায়ে জ¦ালা ধরে, বিষাক্ত হিংসার ছোবলের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। তারা আরেকটি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের নিখুঁত পরিকল্পনার বীজ বোনার স্বপ্ন দেখতে থাকে। সমাজ যদি কলুষিত থেকেই যায়, তাদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া যদি আমরা অব্যাহত থাকতে দিই এবং বাংলা ও বাঙালিবিরোধী শক্তির অস্তিত্ব যদি বিলীন না হয়, ষড়যন্ত্রের বীজ বোনার কাজটি অব্যাহতভাবে থেকেই যাবে- এটাই তো স্বাভাবিক।

তাই বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ যদি আমরা শোধ করতে চাই, একটি মানবিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ যদি আমরা গড়তে চাই, তাহলে এসব ষড়যন্ত্রকারীকে চিরদিনের জন্য সমূলে উৎপাটন করার কাজটি শুরু করতে হবে এখনই। কোনো সাময়িক ব্যবস্থা নয়, কোনো অসম্পূর্ণ উদ্যোগ নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের বাস্তবায়ন সম্ভব একমাত্র একটি পরিকল্পিত সমাজ গড়ার মধ্য দিয়ে, যে সমাজ হবে বাংলার, যে সমাজ হবে বাঙালির। একমাত্র তাহলেই হয়তো বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে।

রাজনীতির মারপ্যাঁচ আর সাময়িক লাভের আশায় যদি আমরা বিবেকের দরজা বন্ধ রাখি, তাহলে আমাদের জন্য খোলা রাখা উন্নত জীবনের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে সর্বত্রই। এই নির্মম সত্যটি উপলব্ধি করা- নিশ্চয়ই ততটা কঠিন নয়।