আজকের দিন তারিখ ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার, ৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় নিস্তব্ধ সময়ে স্বপ্ন দেখার প্রত্যাশায়

নিস্তব্ধ সময়ে স্বপ্ন দেখার প্রত্যাশায়


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১ , ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


শ্যামল দত্ত

পুরো একটা সময় চলছে, যখন সবকিছুই বন্ধ। চারপাশের স্তব্ধ জীবন। মানুষ বন্দি হয়ে আছে সময়ের কাছে। প্রায় একটি বছরের মতো বন্ধ্যা সময় চলে গেল মহাকালের গহ্বরে। কবে সচল হবে সবকিছু? মুক্ত আকাশের নিচে মুক্তভাবে চলাফেরা করবে মানুষ। কোনো বিধিনিষেধ নয়, কোনো নিয়মের বেড়াজাল নয়, কবে আসবে সেই সময়- শঙ্কা আর ভয়হীন সময়। মুক্ত বাতাসে মুক্তভাবে শ্বাস নেয়ার সময়। সে আগের চেহারায় কবে ফিরবে পুরো পৃথিবী? মানুষ জানবে- এই পৃথিবীটা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। একটি ভাইরাসে উলটপালট হওয়া এই পৃথিবী কবে স্বাভাবিক হবে, সেটা কি বলা সম্ভব?

মানুষের জীবন চলছে। কিন্তু এটাকে কি চলা বলে? পৃথিবীর দেশে দেশে এখনো লকডাউন। এখনো অসহায় জীবন নানা বিধিনিষেধে। নতুনভাবে লকডাউন দেয়া হচ্ছে শঙ্কা আর ভয়ের কারণে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এখনো প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে হাজারো মানুষ। প্রতিদিনই মরছে বহু জীবন। এরই মধ্যে ইউরোপে ছড়িয়েছে ভাইরাসের নতুন চেহারা। নতুন করে সংকটে পড়ছে পুরো বিশ্ব। ভ্যাকসিনে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও শঙ্কাতো যায়নি। ভয়ে থাকা জীবনকে তো আর মুক্ত জীবন বলা চলে না।

এরকম একটি সংকটের সময়ে নতুন একটি বছরে পা দিল ভোরের কাগজ। ২৯ বছর পেরিয়ে তিরিশে পা দেয়া ভোরের কাগজ তারুণ্যে টগবগ করার কথা। কিন্তু বৈরী সময়ে ভাটা পড়েছে তারুণ্যে। এখন লড়াই করে টিকে থাকার সময়। সংকটের ভয়াবহতা যখন বহুমাত্রিক, তখন অস্তিত্ব বজায় রাখাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। ২৯ বছর আগে ১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যখন ভোরের কাগজ-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল, তখনো সংকট ছিল বহুমুখী। স্বৈরসরকার এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলেও যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের দাপটে কোণঠাসা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল ভোরের কাগজ। দীর্ঘ ২৯ বছর পর নতুন এই সংকটের মোকাবিলার সংগ্রামে পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের পাশে চায় ভোরের কাগজ।

গণমাধ্যমের সংকট এখন বহুমাত্রিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইনের কারণে মুদ্রণ গণমাধ্যমে উৎসাহ হারাচ্ছেন বহু পাঠক। প্রযুক্তির বিকাশ চ্যালেঞ্জে ফেলেছে শত বছরের পুরনো মুদ্রণ গণমাধ্যমকে। এরকম একটি কঠিন সময়ে করোনা ভাইরাস ও তার বহুমাত্রিক প্রভাবে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে মুদ্রণ গণমাধ্যম।

১৮ কোটি লোকের দেশে ১৪ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক। মানুষ সংবাদ পাওয়ার জন্য কেন পরদিন পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? মুদ্রণ গণমাধ্যমকে তাই ভাবতে হচ্ছে নতুন কিছু- কীভাবে টিকে থাকা যায় প্রতিযোগিতার বাজারে? গণমাধ্যমের একমাত্র আয় হচ্ছে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন এখন চলে যাচ্ছে ইলেকট্রনিক, অনলাইন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে। শুধু সরকারি টেন্ডার ছেপে কীভাবে মুদ্রণ গণমাধ্যম বেঁচে থাকবে? মুদ্রণ গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যাপারে বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতাদের উৎসাহ নেই বললেই চলে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে যেভাবে অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় মুদ্রণ গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে, তাতে এই সংকট আরো বেশি বহুমাত্রিক হয়েছে। বিষয়ে নতুনত্ব, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পাঠকের হৃদয় জয় করা খবরের উদ্যোগ না নিলে প্রথাগত ব্যবস্থায় থাকা মুদ্রণ গণমাধ্যম একদিন হারিয়ে যেতে বাধ্য হবে।

এমন একটি সময়ে গণমাধ্যমের এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে যখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ৫০ বছরে পা দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সুবর্ণরেখার মতো মানুষের জীবনকে স্বর্ণময় করে তুলছে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আজ বাংলাদেশ পৃথিবীর বহু দেশের জন্য অনুকরণীয়। তবে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের এই যাত্রা কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ এই আলোকময় পথের যাত্রী। এ কথাও বলতে হবে যে, বাংলাদেশে সুশাসন ও জবাবদিহিতার নানা সংকট রয়েছে। মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কম নয়। কিন্তু এই বাস্তবতার মধ্যেও এগিয়ে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এমনকি করোনার এই সংকটেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অনেকের কাছে বিস্ময়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ যখন ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার করছে, তখন বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে কাক্সিক্ষত সেই ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ।

সংকটে থাকা মানুষ খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। আমরাও স্বপ্ন দেখতে চাই সমৃদ্ধ সময়ের। এই দুঃস্বপ্নের রাত একদিন কেটে যাবে। ভোরের আলোয় আলোকিত হবে চারপাশ। অন্ধকার কেটে আলোর পথে যাত্রায় ভোরের কাগজ মানুষের সহযাত্রী হয়ে পথ দেখাবে- সেই অঙ্গীকার জানাচ্ছে আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে।

ভারতের প্রখ্যাত শিল্পপতি রতন টাটাকে একজন প্রশ্ন করেছেন, এই করোনার মধ্যে আপনার ব্যবসার অগ্রগতি কেমন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এই সংকটের সময়ে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। লাভ-লোকসানের হিসাব করার অনেক সময় পাওয়া যাবে যদি জীবন টিকিয়ে রাখা যায়। আপাতত টিকে থাক, তারপর নতুন এক ভোরের প্রত্যাশায় ভবিষ্যতের রৌদ্রকরোজ্জ্বল পথে হাঁটা যাবে।

লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক ভোরের কাগজ