আজকের দিন তারিখ ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার, ৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় করোনা ভাইরাস বনাম গুজবের ভাইরাস

করোনা ভাইরাস বনাম গুজবের ভাইরাস


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ৫, ২০২০ , ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


সম্পাদক: শ্যামল দত্ত।
মাঝরাতে হঠাৎ যদি আজানের শব্দ শুনে আপনার ঘুম ভেঙে যায় তাতে চমকানোর কিছু নেই। কিংবা রাস্তার পাশে কাউকে যদি কাঁচা থানকুনি পাতা চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে দেখেন তাতেও ঘাবড়াবেন না। যদি কাউকে দেখেন আস্ত এক কেজি কাঁচা রসুন খেয়ে ফেলার চেষ্টা করছে তাতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এসবই ঘটছে গুজবের কারণে। তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, ওঝা তাবিজের দেশ এই বাংলাদেশ। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে তথাকথিত সামাজিক গণমাধ্যমের গুজব। এসবের কারণে বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস। এর পাশাপাশি ভাসছে গুজবের ভাইরাসও। কাকে সামলাবে কে? স্বাস্থ্য গবেষকরা করোনা ভাইরাসকে ‘পেনন্ডেমিক’ বা মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মিডিয়া গবেষকরা তাদের এই ভাইরাসকে নাম দিয়েছে ‘ইনফোডেমিক’।কোন ভাইরাসটি বেশি ভয়াবহ সেই মূল্যায়ন হয়তো পরে করা যাবে, কিন্তু এখন বিশ্বকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে এই দুই ভাইরাসকেই। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাঝরাতে হঠাৎ আজানের ঘটনা ঘটেছে। হতচকিত মানুষ দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করেছে অজানা ভয়ে, কোন বিপদের আশঙ্কায়। মানুষ পরে জানল, একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং পরদিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই সংগঠন তাদের কৃতিত্ব দাবি করেছে। এই ধরনের উদ্যোগে ধর্মীয় সমর্থন আছে কিনা- তা ধর্মীয় চিন্তাবিদরা বলতে পারবেন কিন্তু হঠাৎ করে সৃষ্টি হওয়া এ ধরনের নানা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা সামলাতে হচ্ছে নানা দেশের সরকারকে। আদা, রসুন ও দারুচিনি সিদ্ধ করে খাওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে বিভিন্ন দেশে। নানা লতা- পাতা, কাঁচা হলুদ, থানকুনি পাতা চিবিয়ে খাওয়ার ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন জায়গায়। গোমূত্র ও গোবর খেলে ভাইরাস ধরবে না এমন আশায় ভারতে বোতলে বোতলে বিক্রি হচ্ছে গরুর মূত্র- যা গোচনা নামে পরিচিত। গোচনা বা গোবর খেয়ে বেশ কয়েকজনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর এসেছে ভারতের গণমাধ্যমে। যোগী গুরু বাবা রামদেবের গোমূত্র খেয়ে হাসপাতালে ভর্তির খবরও ছড়িয়েছে কয়েকদিন। গুজবের এই সংকটটি যে শুধু এই উপমহাদেশের, তা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারকে সামলাতে হয়েছে এই মিথ্যা অপপ্রচার ও অবৈজ্ঞানিক প্রচারণাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কে কয়েকদফা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এর মোকাবিলা করতে হয়েছে। বাজারে পাওয়া যায় এমন দুটি ওষুধ- ক্লোরোকুইন (যা ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে পরিচিত) এবং এজিথ্রোমাইসিন খেয়ে (একটি প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক) করোনা থেকে সেরে ওঠা যাবে এমন প্রচারণা করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে যখন জানা গেল এর সঠিক কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু এর মধ্যে ঢাকার বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে এ দুটি ওষুধ এবং চড়াদামে গোপনে ওষুধ দুটি বিক্রি করল ওষুধ ব্যবসায়ীরা। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ২৬ মার্চ দুপুরে জন্ম নেয়া এক নবজাতক জন্মের পর পরই কথা বলতে শুরু করে এবং বলে- লং, এলাচ আর আদা পানিতে সিদ্ধ করে খেলে আর করোনা ভাইরাস হবে না। এটি বলে মারা যায় শিশুটি। এমন একটি বানোয়াট গল্প ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় লং, এলাচ, আদা সিদ্ধ পানি খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। থানকুনি পাতা খেলেও করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এমন গুজব ছড়ানো হয়েছে বিভিন্ন জেলায় এবং প্রচারণা ছিল এমন যে এই থানকুনি পাতা খাওয়া শুরু করতে হবে ফজরের নামাজের আগে। বরিশাল, গৌরনদী ও নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় রাত জেগে মানুষ থানকুনি পাতা খেয়ে উজাড় করে ফেলেছেন বন-জঙ্গল। সারাদেশের আরো বিভিন্ন এলাকায় রাত ১২টার আগে কালোজিরা, আদা, লবঙ্গ খেলে কোনো ভাইরাস হবে না- এমন গুজবে কালোজিরা খাওয়া শুরু করে দেয় অসচেতন মানুষ। ময়মনসিংহের এক উপজেলায় এক ব্যক্তি দাবি করেন তিনি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ওষুধ স্বপ্নে পেয়েছেন। এই ওষুধ মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের কেউ খেলে মৃত্যুবরণ করবে। মুসলিমরা খেলে করোনা থেকে রক্ষা পাবে। স্বপ্নে পাওয়া এই ওষুধের ফর্মুলা নান্দাইলের কামারগাঁও ব্যাপারীবাড়ি মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের সঙ্গে প্রচারণা চালানোর সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ড দেয়। গুজবের এই বিস্তার শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছে নানাভাবে। রং চা খেয়ে উহানবাসী করোনা মুক্ত হয়েছে এমন গুজব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি করোনা ছড়িয়েছে চীনা প্রযুক্তি ফাইভ-জি টেকনোলজি এবং লেবুর রস খেলে রক্ষা পাওয়া যাবে করোনা ভাইরাস থেকে এমন গুজবও ছড়ানো হয়েছে। গণমাধ্যমে এই গুজব পরিচিত ‘লেমন জুস মিথ’ নামে। গরম বাতাসে শ্বাস নিলে করোনা ভাইরাস মরে যাবে এমন গুজবে হেয়ার ড্রায়ার মুখের ভিতর ঢুকিয়ে গরম বাতাস নেয়ার ঘটনা পশ্চিমা গণমাধ্যমে এসেছে বেশ কিছুদিন। রসুন খেলে করোনা হবে না এই গুজবে কেজি কেজি রসুন খেয়ে ইন্দোনেশিয়ার এক মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়িয়েছে ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে। নামি-দামি ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে এসব গুজব ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে এবং এই সুযোগ তারা নিয়েছে নিজেদের প্রচারণার কৌশল হিসেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বিবৃতি দিতে হয়েছে এসব মিথ্যা প্রচারণা মোকাবিলায়। এমন গুজব বা মিথ্যা প্রচারণা বেশি গুরুত্ব পায় যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় পশ্চিমা দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নানা ধরনের বক্তব্য। বিবিসি সম্প্রতি এক বিশেষ রিপোর্ট দেখিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ১৫ দিনে করোনা নিয়ে ১০ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। কখনো বলেছেন, এটা একটা ফ্লু। এটা এমন কিছু নয়। এরপরই বলেছেন ভয়াবহ অসুখে আক্রান্ত আমেরিকা। একবার বলেছেন সামাজিক দূরত্বের নামে সবকিছু বন্ধ রেখে আমেরিকাকে ধ্বংস করে দিতে পারি না। আবার পরে বলেছেন সবাইকে কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব পালন করতে হবে। একবার বলেছেন, সবাইকে মাস্ক পরার কোনো প্রয়োজন নেই, আবার বলেছেন মাস্ক পরাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। একবার বললেন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। কিছুই হবে না এখানে। আবার হোয়াইট হাউসের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডক্টর ফসির গবেষণা উল্লেখ করে বললেন ২ মিলিয়ন আমেরিকান মরতে পারে করোনা আক্রান্ত হয়ে। তবে এই মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখের কম হলে তিনি খুশি। এর মধ্যে ব্লুমবার্গ খবর ছাপিয়েছে, ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট অথরিটি বা ফেমা এক লাখ বডি ব্যাগ চেয়ে পেন্টাগনের কাছে চিঠি দিয়েছে। পেন্টাগন পরে বিবৃতি দিয়ে এই খবর অস্বীকার করেছে। উন্নত বিশ্বের এসব গুজব দ্রুত মোকাবিলা করা সম্ভব হয় কারণ মানুষ অনেক সচেতন। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ, প্রিন্স চার্লস কিংবা প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ভাইরাসের আক্রান্তের খবর সত্য হওয়া সত্ত্বেও রোনালদো কিংবা পোপের করোনা আক্রান্তের গুজব সাধারণের কাছে পাত্তা পায়নি ঠিকই কিন্তু এর মধ্যে অনেক গবেষক সোশ্যাল মিডিয়ায় মিলিয়ন ডলার ব্যবসার ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব মিথ্যা প্রচার কমাতে হলে সত্যের অবাধ প্রচারে মনোযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সত্য প্রচার ব্যাহত হলে গুজব সেখানে জায়গা করে নেয়। বাংলাদেশের সম্প্রতি খিলগাঁওয়ে লাশ দাফন করতে এলাকাবাসীর বাধা কিংবা তেজগাঁওয়ে করোনা হাসপাতাল বানাতে এলাকাবাসীর প্রতিরোধ মূলত হয়েছে মিথ্যা প্রচারণার কারণে। উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল শুরুতেই করোনা রোগের চিকিৎসা দিতে গিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীর আক্রমণ ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটেছে শুধু গুজব ও মিথ্যা প্রচারণার কারণে। লাশ থেকে ভাইরাস ছড়ায় কিংবা রোগীর ছড়ানো ভাইরাসে এলাকাবাসী আক্রান্ত হবে- এমন গুজব ছড়ানোর আগে এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি বা বিস্তারিত তথ্য দিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রচারণা করা উচিত ছিল। তা না হওয়ার কারণে এসব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কলকাতায় এই সংকটের কারণে করোনায় মৃত্যুবরণ করা এক মুসলিমের লাশ শ্মশানে পোড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে দুই হিন্দুধর্মাবলম্বীর লাশ শ্মশানে পোড়াতে না দেয়ায় কবর দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ এই সংকট মোকাবিলায় কঠোর আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। সিঙ্গাপুরে করোনা ভাইরাস নিয়ে মিথ্যা প্রচার বন্ধে কঠোর আইন হয়েছে গত সপ্তাহে। থাইল্যান্ড অ্যান্টি ফেক নিউজ সেন্টার বানিয়েছে এবং করোনা গুজব মোকাবিলা করার জন্য ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় গত ৭ দিনে ভুয়া খবর প্রচারের জন্য ৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। সিঙ্গাপুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নাইজেরিয়া একই ধরনের আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন সমাজে সচেতনতা তৈরি না করে শুধু আইন দিয়ে এর মোকাবিলা করা কঠিন। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল কিন্তু এর ৬ বছর পর রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা গুজবে এক নিরীহ নারী রেনুর মৃত্যু আমরা ঠেকাতে পারিনি। গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকায় করোনা ভাইরাসে ২৭ জন মারা গেছে বলে প্রচার চালানো আবু নাঈম নামক গ্রেপ্তারকৃত এক ব্যক্তিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাব্বির আহসান চৌধুরী একদিনের রিমান্ড শেষে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। দেশে ৩৭টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে ভুয়া খবর ও গুজব প্রচারের জন্য। এলিট ফোর্স র‌্যাব গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে তাদের অফিসিয়াল প্যাড ব্যবহার করে গুজব ছড়াচ্ছে একটি মহল। এ বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে সবাইকে। শেষ করব দুটি বহুল প্রচারিত আন্তর্জাতিক গুজব দিয়ে। রাশিয়াতে লকডাউন নিশ্চিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খাঁচা খুলে মস্কোর রাস্তায় সিংহ ছেড়ে দিয়েছেন বলে সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবিসহ খবর প্রচার পেয়েছে। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার করোনা আক্রান্ত ৬ জন কোরীয় নাগরিককে গুলি করে মেরে করোনার বিস্তার বন্ধ করেছেন বলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয়েছে। করোনা আক্রান্ত এসব রোগীকে গুলি করে মারার একটি দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যায়। কিন্তু বিবিসির তথ্য যাচাই টিম বলছে দুটি খবরই অসত্য। বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর সত্য-মিথ্যার এই ব্রহ্মাণ্ডে মহাপুরুষদের কিছু বাণীতে আমাদের আস্থা রাখতে হয়। সে কারণেই হয়তো গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, তিনটি জিনিসকে কখনো চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব না। এই তিন বস্তু হচ্ছে চন্দ্র, সূর্য এবং সত্য।