আজকের দিন তারিখ ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
জাতীয় ওএমএস দোকানে মানুষের দীর্ঘ লাইন

ওএমএস দোকানে মানুষের দীর্ঘ লাইন


পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: নভেম্বর ২০, ২০২২ , ১২:০১ অপরাহ্ণ | বিভাগ: জাতীয়


মোস্তাফিজুর রহমান : খাদ্য অধিদপ্তরের অধীনে বাজারে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও ১৮ টাকায় আটা কেনার জন্য ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) দোকানগুলোতে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই নন, মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনও খোলা বাজার দরে চাল ও আটা কেনার জন্য ওএমএস দোকানগুলোয় ভিড় করছেন। ওএমএস দোকান থেকে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি আটা ক্রয় করার সুযোগ রয়েছে। আর এ সুযোগকে নিম্ন আয়ের মানুষ যেমন কাজে লাগাতে চান, তেমনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষও স্বল্পমূল্যে পণ্য পেতে ছুটছেন ওএমএস দোকানে। বর্তমানে বাজারে মোটা চাল কিনতে হলেও কেজিপ্রতি গুনতে হয় ৫৫-৬০ টাকা, আর আটার দাম আরো বেশি প্রতি কেজি আটা ৭০ টাকা। এত শুধু চাল, আটার মূল্য। অন্যান্য পণ্যের দামও আকাশচুম্বী। স্বল্প আয়ের মানুষ এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই সংসারের চাকা সচল রাখতে তারাও এখন ভিড় করছেন ওএমএস দোকানে।
রাজধানীতে ১০৪টি ওএমএস দোকান দৈনিক ‘এ’ ক্যাটাগরির ৩ টন চাল ও ৩ টন আটা; ‘বি’ ক্যাটাগরির ২ টন চাল ও ২ টন আটা বিক্রির জন্য বরাদ্দ পান। রাজধানীর মালিবাগ শাহী মসজিদের সামনে ওএমএস দোকানে স্বল্প মূল্যে চাল-আটা ক্রয় করতে আসা অনেকে জানান, সকাল ৯টায় ওএমএস দোকান খোলা হয়। কিন্তু সকাল ৬টা থেকেই দোকানের সামনে লোকজন ভিড় করতে থাকেন। আবার কেউ কেউ ফজরের নামাজ আদায় করেই লাইনে দাঁড়িয়ে যান। সকাল সাড়ে ৭টায় আসা এমন কয়েকজনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হলে তারা জানান, সকাল ৭টায় এসেও তারা পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে তাদের অভিযোগ- স্থানীয় কিছু বাসা-বাড়ির গার্ড, দারোয়ান ও বাসা-বাড়িতে কাজ করেন এমন মহিলারা সিন্ডিকেট করে প্রতিদিন ওএমএসের মাল তুলছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ একজন লাইনে এসে ৫-৭ জনের সিরিয়াল রেখে চলে যান। পরে পণ্য দেয়া শুরু হলে তারা লাইনে দাঁড়িয়ে যান। কবির হোসেন নামে একজন ড্রাইভার জানান, তিনি সকাল সাড়ে ৭টায় এসে ৮ জনের পেছনে ছিলেন, এখন তার সিরিয়াল নম্বর এসে দাঁড়িয়েছে ৭৬ নম্বরে। তার এত পেছনে যাওয়ার কারণ হিসেবে ওই সিন্ডিকেটকেই দায়ী করলেন। এটা শুধু কবির হোসেনের একার অভিযোগ নয়, এমন অভিযোগ করেছেন আরো অনেকেরই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন বলেন, অফিস থেকে দুই ঘণ্টার জন্য ছুটি নিয়ে এসে এখন ৩ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তার সিরিয়াল আসার আগেই মাল শেষ। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পক্ষে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল-আটা পাওয়া মুশকিল।
এদিকে লুবনা, মিথিলা, মুনা নামের কয়েকজন মহিলা জানান, এখানে কিছু মহিলা ও পুরুষের দাপটে লাইনে দাঁড়ানোই মুশকিল। একজন এসে দাঁড়িয়ে পরে মেয়ে, ছেলের বউ, বোন এমন করে ৫-৭ জনের সিরিয়াল রেখে মাল তুলে নিয়ে যায়। তাদের কিছু বললে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
কথা হয় রিকশাচালক মেহের আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, রিকশা নিয়ে বেরিয়ে একটি সিরিয়ালের জন্য কয়েকবার এসেছি। শেষ পর্যন্ত ৮১ নম্বর সিরিয়াল পেয়েছি। শুনেছি এটাই শেষ। জানি না আজও মাল পাব কিনা। গতকাল লাইনে দাঁড়িয়েও খালি হাতে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে।
খিলগাঁও পল্লী বন্ধু এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এসেছে মায়ের পরিচয়পত্র নিয়ে। ছোট্ট ওই শিশুটি জানায়, মা কাজে গেছে তাই মায়ের হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে সে। কাজ শেষে মা আসবে। দিনমজুর মহিমা বেওয়া (৫৫) বলেন, ‘আগে অল্প সময় লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য পেতাম। এখন আর পাওয়া যায় না। বাসায় অসুস্থ’ স্বামীকে রেখে তাই বাধ্য হয়েই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবুও আশায় থাকি, যদি ৫ দিন দাঁড়িয়ে দু’একদিনও পণ্য পাওয়া যায়। এতে সংসারের কিছুটা হলেও অভাব দূর হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এমন একজন জানান, ৫ বছর আগে ভালো বেতনে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তিনি অল্প বেতনে চাকরি করছেন। স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ মোট চার সদস্যের ছোট পরিবার। বড় ছেলে সরকারি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। ছোট পরিবার, তার পরও বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে তিনি আর পেরে উঠছেন না। তাই বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তারও একই কথা, লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য পাবেন কিনা নিশ্চিত নয়।
এদিকে সাবিনা, শিউলী, আসমা, সাকিব- প্রত্যেকের প্রায় অভিন্ন কথা। কেউ কেউ করোনার সময় চাকরি হারিয়ে ছোটখাট ব্যবসা করছেন, আবার কেউবা ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। অনেকের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৩-৪ জন হলেও সংসার চালাতে গিয়ে অনেকের কাটছাঁট করতে হচ্ছে, তারপরও সংসার ঠিকমতো চলছে না। একজন মহিলা জানান, তার দুই সন্তান, সংসারের খরচ অনেক বেড়েছে। বাজার থেকে বেশি দামে চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই চাল-আটা কিনতে ওএমএস দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েছে। মালিহা নামে একজন গৃহবধূ বলেন, ‘লজ্জায় অনেক সময় কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখি। পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলেন সেই ভয়ে। ভাই পেট তো আর পরিচিত-অপরিচিত বুঝে না। ছেলে-মেয়েদের পুষ্টিকর খাবার তো খাওয়াতেই পারি না, তার ওপর চারটা ডাল-ভাত খাওয়ানো, তাও এখন পারছি না।’ তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়ানো কিছু কিছু মহিলার ব্যবহার এতটাই খারাপ, যা অসহ্যকর পরিবেশ তৈরি করছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ভুক্তভোগীরা অনুরোধ জানান, ভাই এদের বিষয়ে একটু লেখেন, যাতে আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ স্বা”ছন্দ্যে কাক্সিক্ষত পণ্য নিতে পারি।
এ অভিযোগ সম্পর্কে ওএমএস দোকান কর্তৃপক্ষের পক্ষে মো. সবুজের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সাধারণ মানুষের অভিযোগ সত্য। কিন্তু আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমরা এ ব্যাপারে অনেককে বলেছি, আপনারা প্রতিদিন কেন পণ্য গ্রহণ করেন। তাদের কথা মাল নিতে তো কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, দোকানের সামনে বেশির ভাগ মহিলাই বেশ ঝামেলা করেন। মানে তাদের ভাষা এমন পর্যায়ে গিয়ে পড়ে, যা সামাল দেয়া আমাদের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য। সবুজও চান সবাই তাদের দোকান থেকে পণ্য পাক। তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান, তারা যে পরিমাণ চাল-আটার বরাদ্দ পান, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সবুজ আরো বলেন, ‘প্রত্যেক ডিলারের দৈনিক বরাদ্দ আরো বাড়ালে সুবিধাভোগীর চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারতেন। মাল কম থাকার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই বরাদ্দকৃত চাল-আটার বিক্রি শেষ হয়ে যায়। যে কারণে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ অনেক সুবিধাভোগীকে খালি হাতে ফিরে যেতে হ”েছ।’ তিনি আরো বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ওএমএস দোকানগুলোয় চাল-আটার জন্য মানুষর ভিড় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
এদিকে ওএমএসের আটার দাম সরকার বাড়িয়েছে ভর্তুকি কমাতে। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, উ”চ দামে গম কিনে ভর্তুকি দিয়ে তারা ১৮ টাকা কেজিতে খোলা আটা বিক্রি করত। এখন থেকে নতুন দর হবে ২৪ টাকা। আর প্যাকেটজাত আটার দুই কেজির প্যাকেট খাদ্য অধিদপ্তর বিক্রি করবে ৫৫ টাকায়, যা এত দিন ৪৩ টাকা ছিল। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যয় বাড়বে।